ফিলোসফি ইজ ডেড

By:

Format

হার্ডকভার

Country

বাংলাদেশ

1,070

বইটি বর্তমানে আমাদের সংগ্রহে নেই। আপনি বইটি প্রি-অর্ডার করলে প্রকাশনায় মুদ্রিত থাকা সাপেক্ষে ৪-৮ সপ্তাহের মধ্যে ডেলিভারি করা হবে।

প্রাচীন পৃথিবীর অন্ধকারে, যখন মানুষ মাত্রই আগুনের রহস্য আবিষ্কার করেছে, তখন থেকে দর্শনশাস্ত্র মানুষের সঙ্গী। পথের ধারে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা বৃক্ষের মতো দর্শনশাস্ত্র দাঁড়িয়ে ছিল, যেন কেউ এসে তার ছায়ায় বিশ্রাম নেবে। মানুষের মনে প্রশ্ন এসেছে—এই বিশাল পৃথিবী কেন? জীবনের উদ্দেশ্য কী? সৃষ্টির মর্ম কী? সভ্যতার চলার পথে এইসব প্রশ্ন বারবার উঠে এসেছে। তখন দার্শনিকেরা তাদের চিন্তার আলো দিয়ে পথ দেখিয়েছেন। সেই আলোতেই তৈরি হয়েছে সভ্যতার নকশা, নীতি, বিজ্ঞান এবং আত্মজ্ঞান।

কিন্তু আজ, আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক অন্য যুগের প্রান্তে। এখন আমাদের চারপাশে প্রযুক্তির দাপট। আমাদের হাতে ডেটা, যন্ত্রের অসীম ক্ষমতা, আর এমন সব বিজ্ঞানসম্মত যন্ত্রণা ও সম্ভাবনা, যা আগে কেবল কল্পনাই ছিল। আজ বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি আমাদের বলে, তারা এমন সব প্রশ্নের উত্তর জানে যা একদিন কেবল দর্শনের ছিল। চেতনা কি কেবলই নিউরনের খেলা? বাস্তবতা কি শুধুই মহাজাগতিক ত্রিমাত্রিকতার ফল? কীভাবে বাঁচা উচিত, তার জন্য কি আর দর্শনের আশ্রয় নেওয়ার দরকার আছে?

অনেকের মনে প্রশ্ন, আজ দর্শনের জায়গায় প্রযুক্তির জটিল সমাধান এসে বসেছে। এখন দর্শন যেন ধূসর স্মৃতির মতো, পুরোনো পাণ্ডুলিপির মতো। কেউ কেউ বলে, দর্শনশাস্ত্র হয়তো এখন অপ্রয়োজনীয়; এক শুষ্ক পুরাকথা। কিন্তু ঠিক যেন গ্রীষ্মের শেষে মাটি ভেদ করে আসা প্রথম বৃষ্টির ঘ্রাণের মতো, অনেকেই মনে করেন—দর্শনকে এত সহজে মুছে দেওয়া যাবে না।

প্রাচীন গ্রিসে, যখন রাতের আকাশে নক্ষত্রগুলো মানুষের কাছে অজানা রহস্যের মতো ঝিকমিক করত, তখনই জন্ম হয়েছিল দর্শন আর বিজ্ঞানের এক নিবিড় বন্ধনের। দার্শনিকেরা শুধু চিন্তা করতেন না; তারা প্রশ্ন করতেন, দেখতে চাইতেন এই বিশাল পৃথিবীর অদেখা কোণগুলোকে। তাদের সেই তৃষ্ণা যেন আকাশে উড়তে থাকা এক বিশাল পাখির মতো, যাকে কোনো সীমায় বাঁধা যায় না।

অ্যারিস্টটল তখন তাঁর চিন্তায় আঁকতে চেয়েছিলেন এক অখণ্ড চিত্র। নৈতিকতা, জীববিদ্যা, এমনকি মহাবিশ্বেরও গভীর রহস্য—সবকিছু যেন একটা সুরে বাঁধা, একটা একক সুরেলা সত্য। তাঁর কাছে জীবন ছিল একটা সংগীতের মতো, যেখানে প্রতিটি নোট একে অপরের সাথে যুক্ত।

আর পিথাগোরাস? তাঁর চোখে সংখ্যা ছিল সেই মহাজগতের লুকানো ভাষা। গণিতের ধাঁধাঁ যেন তাঁকে বলে দিত বাস্তবতার ছন্দ। সংখ্যা আর জ্যামিতির মাধ্যমে তিনি দেখতে চেয়েছিলেন এই জগতের আড়ালে থাকা এক ছায়াময় কাঠামোকে, যেন প্রতিটি সংখ্যা পৃথিবীর গভীর কোনো গোপন কথা ফিসফিস করে বলে দেয়।

কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেই সুর ভাঙতে শুরু করল। এনলাইটেনমেন্টের আলো এসে দর্শনের সঙ্গে বিজ্ঞানের সেই বন্ধনকে আলাদা করল। গ্যালিলিও আর নিউটন সেই নতুন আলোর পথিক। তাঁরা বুঝলেন, কেবল চিন্তা করলে চলবে না। তাঁরা বললেন, “দেখো। প্রমাণ করো। পরীক্ষা করো।”

গ্যালিলিও রাতের আকাশে দূরবীন তাক করে বললেন, “এই দেখো, গ্রহেরা যেমন বলে এসেছে, তেমন নেই।” আর নিউটন, আপেলকে পড়তে দেখে বুঝলেন, পৃথিবীকে বেঁধে রেখেছে এক অলঙ্ঘ্য শক্তি। এই নতুন সত্যের সন্ধানে বিজ্ঞান হয়ে উঠল পরীক্ষার ও পর্যবেক্ষণের পথিক। ধীরে ধীরে দর্শনকে দূরে সরিয়ে বিজ্ঞান তার শক্তি আর প্রমাণের ভরসায় এগিয়ে চলল।

এইভাবে দর্শন আর বিজ্ঞানের পথ আলাদা হতে থাকল। বিজ্ঞান হয়ে উঠল তীক্ষ্ণ বাস্তবতার অস্ত্র। আর দর্শন? সে যেন তার পুরোনো স্বপ্ন আর গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে, এক মধুর নীরবতায় দাঁড়িয়ে রইল। যেন রাতের আকাশের কোনো এক নক্ষত্র, যা আজও ঝিকমিক করে, কিন্তু তার আলোর কাছে পৌঁছানোটা যেন কেবল দূরের এক স্বপ্ন।

১৯ শতকের দিকে এসে, বিজ্ঞান যেন নিজস্ব প্রাণ পেল। প্রযুক্তির উন্নয়ন আর বাস্তব আবিষ্কারগুলো তাকে এগিয়ে নিয়ে চলল দুরন্ত গতিতে। ২০ শতকে, সেই চলার পথ আরও প্রশস্ত হলো। মানসিকতার রহস্য উদ্ঘাটনে এল নতুন নতুন বিজ্ঞান—মনোবিজ্ঞান, স্নায়ুবিজ্ঞান, এবং জেনেটিক্স। একসময় যা ছিল দর্শনের নিভৃত ক্ষেত্র, সেই প্রশ্নগুলোকে বিজ্ঞান সরাসরি স্পর্শ করতে শুরু করল।

মানুষের আচরণ আর চেতনার মতো গভীর বিষয়, যা আগে কেবল ধ্যান-ভাবনার আর বিতর্কের আলোকে আলোচিত হতো, এখন রূপ নিলো বৈজ্ঞানিক অধ্যয়নের। স্নায়ুবিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের জটিলতা খুঁজে পেতে স্ক্যানের সাহায্য নিলেন। মনোবিজ্ঞানীরা মানুষের আচরণের ওপর পরীক্ষা চালালেন, আর জেনেটিসিস্টরা জীবনের গোপন নকশা খুঁজে পেলেন ডিএনএ-এর ছন্দে।

প্রতিটি নতুন আবিষ্কারের সাথে সাথে দর্শনের আঙিনা যেন একটু একটু করে সংকুচিত হতে থাকল। বিজ্ঞান একের পর এক প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল, আর প্রতিটি উত্তর যেন দর্শনের প্রয়োজনীয়তাকে কমিয়ে দিচ্ছিল। বিজ্ঞান যে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিচ্ছিল, সেই প্রশ্নগুলো একসময় দর্শনেরই ছিল। আর এখন, প্রতিটি বৈজ্ঞানিক উত্তর যেন দর্শনের দিকে তাকিয়ে বলে—“তোমাকে আর প্রয়োজন নেই।”

প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের ঝলমলে আলোর নিচে দাঁড়িয়ে অনেকেই আজ প্রশ্ন তুলছেন—দর্শনের জায়গা কোথায়? যদি বিজ্ঞান ক্রমশ আরও স্পষ্টভাবে আমাদের মহাবিশ্বকে বর্ণনা করতে পারে, তবে কেন দরকার সেই পুরনো চিন্তার পথে হাঁটার? অনেকের কাছে দর্শন যেন এক দূরবর্তী সুর, যার সুরেলা মাধুর্য আজ আর কাজের নয়, শুধু স্মৃতির মতো।

এই প্রশ্ন কেবল একাডেমিক নয়; এটি আমাদের সময়ের আরেকটি বাস্তব সংকট। আজ যখন সমাজ প্রতিটি সমাধানের জন্য বিজ্ঞানের দিকে তাকিয়ে থাকে, তখন দর্শনের ধীর, নীরব প্রশ্নগুলো অনেক সময় অবহেলিত হয়। ধৈর্য ধরে প্রশ্ন করা, যেকোনো কিছুকে সমালোচনার আলোয় দেখা—এগুলোকে অপ্রয়োজনীয়, এমনকি সময়ের অপচয় বলেও ধরা হয়। মনে হয়, দর্শন কেবল অতীতের একটি প্রতিধ্বনি, যা এখন আর আসল জীবনের সাথে কোনো যোগসূত্র স্থাপন করতে পারে না।

কিন্তু ঠিক এই প্রযুক্তির আলোর নিচেই, যখন মানব মস্তিষ্ক আর রোবটের ক্ষমতা প্রায় সমান হয়ে আসছে, তখনই নতুন নতুন নৈতিক ও অস্তিত্বের প্রশ্ন এসে দাঁড়াচ্ছে আমাদের সামনে। কী হবে যদি মানুষ আর যন্ত্রের মাঝে পার্থক্য ঘুচে যায়? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কি কখনো মানবিক অনুভূতির গভীরতা স্পর্শ করতে পারবে? জীবন যদি কেবল ডিএনএ আর নিউরনের খেলা হয়, তবে তার অর্থ খুঁজে পেতে কি কোনো নতুন প্রশ্ন উঠে আসবে না?

এই সব প্রশ্নের উত্তর বিজ্ঞানের পরীক্ষাগারে নেই। এই সব প্রশ্ন আমাদের আবারও দর্শনের কাছে ফিরিয়ে নেয়, সেই চিরন্তন ভাবনার দিকে, যা নতুন করে জানতে চায়—সবকিছুর শেষ কোথায়?

যখন বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি আমাদের চোখের সামনে পৃথিবীকে নতুন করে আঁকছে, তখন মনে হয়, জীবন যেন এক জটিল যন্ত্রের খেলা। কীভাবে পরমাণুগুলো পরস্পরের সাথে নাচছে, কীভাবে বিবর্তন আমাদের এই রূপে নিয়ে এসেছে, কীভাবে আমরা নিজস্ব জিন বদলে নিজেদেরই গড়তে পারি—এসব প্রশ্নের উত্তর আজ প্রযুক্তির হাতের মুঠোয়। কিন্তু, এখানেই শেষ নয়। এই সব “কীভাবে” প্রশ্নের বাইরেও থেকে গেছে এক গভীর প্রশ্ন, “কেন?”।

“কেন” এই সবকিছুর মূল রহস্য? এই প্রশ্ন কেবল একটি নিরীহ কৌতূহল নয়; এটি জীবনের গভীরতম আকাঙ্ক্ষা। কেন আমাদের অস্তিত্বের কোনো অর্থ আছে? কেন আমরা নৈতিকতা নিয়ে ভাবি? কেন কোনো আনন্দ, দুঃখ, বা প্রেম আমাদের হৃদয়ে গহীনভাবে অনুরণিত হয়? এইসব প্রশ্নের সামনে বিজ্ঞান থমকে দাঁড়ায়। তাদের জবাবের কাঠামো, তাদের নির্ভুল গণনা কোনোভাবেই আমাদের অনুভবের এই গভীরতা ছুঁতে পারে না।

শুধুমাত্র দর্শনই এই প্রশ্নগুলোকে জীবন্ত রাখে। এর কাজ হয়তো চূড়ান্ত উত্তর দেওয়া নয়, বরং প্রশ্নগুলোর সেই প্রাচীন স্পন্দন ধরে রাখা, যাতে করে মানুষ তাদের উত্তর খুঁজে পেতে আবারও ফিরে আসে নিজের মননের দিকে। দর্শন কোনো সহজ সমাধান দেয় না, এটি এক চিরন্তন ।

Writer

Publisher

Pages

472

Country

বাংলাদেশ

Format

হার্ডকভার

0 reviews
0
0
0
0
0

There are no reviews yet.

Be the first to review “ফিলোসফি ইজ ডেড”

Your email address will not be published. Required fields are marked *

1 2 3 4 5
1 2 3 4 5
1 2 3 4 5